১ম পর্ব:
এদেশে বর্তমান সময়ের এবং সম্ভবত বিগত দুই দশকের সবচেয়ে আলোচিত ও উৎকণ্ঠার ইস্যু হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা তথা ব্যভিচার (যিনা), ধর্ষণ, ইভটিজিং, অযাচার, যৌন হয়রানি ইত্যাদি। দিন দিন এ সমস্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে এসব অনাকাক্সিক্ষত সংবাদ। সোশ্যাল মিডিয়া বলি কিংবা আমাদের সামাজিক-পারিবারিক আড্ডা বলি সবখানেই এই এক আলোচনা। মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে এটা যেমন আমাদের মানবিকতার অবক্ষয়ের জ্বলন্ত উপমা, তেমনই ইসলামী আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের সীমাহীন ঘাটতির কথাই প্রচার করছে। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস আমরা বেশিরভাগ জনগণই হয়তো এ পাপ বা গুনাহ থেকে মুক্ত। কিন্তু কতিপয়ের কারণেও যে এই অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে তার দায়ভার আমরা এড়াতে পারি না। যারা এসব করছে তারা আমাদেরই কারো ভাই, কারো বন্ধু, কিংবা আত্মীয়, নতুবা পরিচিত। সুতরাং সমস্যাটাকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং এর গভীরে প্রবেশ করে স্থায়ী ও টেকসই সমাধানই আমাদের কাম্য।
আমরা অবশ্য সমাধান প্রচেষ্টায় একেবারে নিরবও নই। বিবেকবান সব মানুষ, শিক্ষিত-মূর্খ, তরুণ-বৃদ্ধ সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে সমাধান প্রদানেও উচ্চকিত। এক্ষেত্রে ডান-বামের বিভেদও খুব একটা দেখা যায় না, সবাই আমরা এসব ঠেকাতে চিন্তিত। সভা-সেমিনার, সেম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠক, উচ্চ পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী আলোচনা, গবেষণা ইত্যাদি কী না হচ্ছে? আসলেও তাই হওয়া উচিত। তারপরও ব্যভিচার বা ধর্ষণ কমছে না বরং দিন দিন বাড়ছে। সম্ভবত এমন কোনো দিন নেই যেদিন মিডিয়ার সংবাদে এসবের খবর নেই। এর একটাই কারণ- এসব বন্ধের যত আইন ও পদ্ধতিই গৃহীত হচ্ছে সবই অকার্যকর। কারণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও এর সমাধানে সর্বাত্মক ও যথাযথ গবেষণার অভাব। একমাত্র মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান এবং ইতিহাস ও সামাজিক অবস্থানের বিবেচনা মাথায় নিয়ে যথাসিদ্ধ গবেষণা হয়তো এর সমাধান আনতে পারে। তবে অনেকের নিকট বিস্ময়কর মনে হলেও এটা সত্য যে, প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বেই ইসলাম এর সমাধান দিয়ে গিয়েছে। ইসলাম এ সমস্যায় যে সমাধানের পথ দেখিয়েছে, তা নিশ্চতরূপেই বাস্তবসম্মত, মানবিক ও কার্যকর।
ক. ব্যভিচার বা ধর্ষণ রোধে আমাদের উচিত সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। এ লক্ষ্যে স্বীকৃত গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করাই উত্তম। তা হচ্ছে- সমস্যা চিহ্নিত করার পর এর সমাধানের জন্য সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে এ সমস্যার কারণ চিহ্নিত করা। তারপর কারণের উপাদান, প্রভাবক, পরিপ্রেক্ষিত, প্রেক্ষাপট সব বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের পথ চিন্তা করা। সে হিসেবে ধরে নেওয়া যায়- “সমস্যা >কারণ >প্রেক্ষাপট” সমীকরণে আমাদের উদ্দিষ্ট ফর্মুলা হলো-
– প্রথমত: সমস্যা- ধর্ষণ, যৌনাচার ইত্যাদি
– দ্বিতীয়ত: কারণ- মানসিকতা
– তৃতীয়ত: প্রেক্ষাপট (উপাদান/প্রভাবক) -অর্থাৎ মানসিকতার কারণ বা পরিপ্রেক্ষিত। মোটাদাগে বলা যায়, নৈতিক-সামাজিক অবক্ষয়, অশ্লীলতার প্রসার, মিডিয়া ও সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য আগ্রাসন, যথাযথ আইন ও এর বাস্তবায়নের অভাব, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, পর্দা প্রথার শিথিলতা ইত্যাদি।
এখানে পাঠকদের দ্বিমত থাকতেই পারে। প্রেক্ষাপটকেও কেউ কোনো ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারেন কিংবা অনেকে ভাবতে পারেন তৃতীয়টি, অর্থাৎ প্রভাবক নিজেই সরাসরি সমস্যার সাথে জড়িত। তবে সমস্যা যেহেতু মানুষ সম্পর্কিত সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষভাবে হলেও তাদের মানসিকতা, মানবিক দৈন্যতা এসব কার্যকর থাকবেই। প্রেক্ষাপট বা প্রভাবক হিসেবে আরো অনেক বিষয় আসতে পারে; শুধু কয়েকটি ছাড়া সব কিছু এখানে উল্লেখ করিনি।
সমীকরণের দ্বিতীয় স্তরে মানসিকতাকে উল্লেখ করার কারণ তৃতীয় স্তরের এসব বিষয় সচরাচর মানুষের মানসিকতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজ করে থাকে। এতদসত্ত্বেও এসব উপাদান সব মানুষকে সমানভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। মানুষের পরিচালক হচ্ছে নফস। নফসের যথাযথ পরিভাষা বাংলায় নেই। অন্তর, হৃদয়, প্রবৃত্তি এসব নানা অর্থেই এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উপস্থাপকের বা বক্তার উদ্দেশ্য অনুপাতে এসব অর্থ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে অর্থ যা-ই হোক, নফসই মূলত মানুষের মানসিকতার নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি।
খ. আমরা জানি, মানুষের নফস (প্রবৃত্তি) তিন ধরনের- নফসে আম্মারাহ, নফসে লাওওয়ামাহ ও নফসে মুত্বমায়িন্নাহ। (অনেকে এগুলোকে নফসের প্রকার না বলে, নফসের তিন ধরনের অবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন)
মানুষের মধ্যে যখন নফসে আম্মারাহ (কু-প্রবৃত্তি) প্রভাব বিস্তার করে তখন সে পশুত্বের পর্যায়ে চলে যায়। শয়তানের প্ররোচনা বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে নফসে আম্মারাহ প্রবল হয়ে উঠলে মানুষ খারাপ কাজকেই প্রাধান্য দেওয়া শুরু করে। পবিত্র কুরআনে সরাসরি এ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়, “নিশ্চয় নাফস মন্দ কজের নির্দেশ দিয়ে থাকে” (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৫৩)। দ্বিতীয় প্রকারের নফস হলো নফসে লাওওয়ামাহ বা তিরস্কারকারী নফস। এ নফস নিজের খারাপ কাজের জন্য নিজেকে তিরস্কার করে ও পাপ হতে বিরত থাকতে প্রেরণা দেয়। অনেকে নফসের এ অবস্থাকে ‘বিবেক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে, “আমি শপথ করি কিয়ামত দিবসের এবং আরও শপথ করি সেই মনের, যে নিজেকে ধিক্কার দেয়” (সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ১-২)। তৃতীয় প্রকারের নফস হলো নফসে মুত্বমায়িন্নাহ বা প্রশান্ত হৃদয়। এটি হচ্ছে প্রতিশুদ্ধ অন্তর, যে অন্তর খারাপ কাজ ও প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত। আল্লাহ তাআলা এরূপ অন্তরকেই উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “হে প্রশান্ত মন, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার (বিশিষ্ট) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর” (সূরা ফাজর, আয়াত ২৭-৩০)।
ব্যক্তি মানুষের নফস বা প্রবৃত্তির ন্যায় একই সমাজ ও পরিবেশে বাস করেও আমরা নারীর প্রতি যৌনাচারের ক্ষেত্রে সাধারণত তিন শ্রেণির মানুষ দেখতে পাই-
ক. সৎ মানসিকতাসম্পন্ন; পরিবেশের উপাদানসমূহ যাকে খারাপ করতে পারেনি।
খ. দুর্বল মানসিকতাসম্পন্ন; এ প্রকৃতির মানুষ সাধারণত সুযোগ সন্ধানী। সুযোগ পেলে খারাপ কাজ করতে পারে, আবার অনুশোচনাও করে।
গ. খারাপ মানসিকতাসম্পন্ন; এরা নিজেরাই সুযোগ সৃষ্টি করে নেয়।
এ তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিটি শ্রেণিতে আবার মাত্রাগত তারতম্যও বিদ্যমান। যেমন সৎ মানসিকতাও সবার একরকম নয়। কেউ হয়তো জীবনের বিনিময়েও এসব খারাপ কাজে প্রবৃত্ত হবে না। কেউ হয়তো অবস্থার স্বীকার হয়ে শয়তানের প্ররোচনায় খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। এটা অনেকটা তাকওয়ার স্তর বিন্যাসের মতো। [তাকওয়ার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যেমন- কুফর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকা, হারাম থেকে বেঁচে থাকা, মাকরূহ থেকে বেঁচে থাকা, যেসব কাজ আখিরাতের জন্য উপকারী নয় সেসব মুবাহ ও জায়িয কাজ থেকেও বেঁচে থাকা, যেসব কাজ আল্লাহকে পাওয়ার জন্য কাজে লাগে না তা থেকেও বেঁচে থাকা ইত্যাদি।]
এখন সমাজকে সার্বিক বিচারে যৌনাচারের অন্ধকার থেকে মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্যোগ। অর্থাৎ শুধু খারাপ মানসিকতা সম্পন্ন লোকদের ভালো করার উদ্যোগ নেওয়া হলো, বাকী দুই শ্রেণিকে নিরাপদ মনে করা হলো। তাতে সমস্যা কমবে না। কারণ প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির লোক এসব করবে না, এটা সুনিশ্চিত নয়। মানুষ ফেরেশতা নয়, প্রবৃত্তি ও শয়তান সর্বদাই মানুষের পেছনে লেগে আছে। সুতরাং প্রয়োজন সবাইকে সমভাবে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
তৃতীয় শ্রেণির মানুষকে হয়তো আইন দিয়ে আটকে রাখা যায়। অর্থাৎ শাস্তিমূলক আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন। আবার দ্বিতীয় শ্রেণিকে মোটিভেশন কিংবা পরিবেশের সুস্থতার দ্বারা প্রথম পর্যায়ে উন্নীত করা যায়। অর্থাৎ খারাপ কাজের পথ বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে এ সমস্যা থেকে মুক্ত রাখা যায়। প্রথম পর্যায়ের লোকদের এসব বিরোধী ক্যাম্পেইনে সরাসরি সম্পৃক্ত করেও তাদের সৎ গুণাবলি অটুট রাখার ব্যবস্থা করা যায়।
গ. আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, শুধু তিন শ্রেণির মানুষের উপর কাজ করাই যথেষ্ট নয়। বরং সমস্যাকে সার্বিক বিচারে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এমন নয় যে শুধু প্রভাবক বা উপাদানগুলো নিয়েই কাজ করলাম কিন্তু এর পেছনের মানসিকতাকে স্বাধীন ছেড়ে দিলাম। এতে তৃতীয় শ্রেণির মানুষের অবাধ যৌনাচারের সুযোগ থেকেই যায়। কেননা তারা এবং প্রথম শ্রেণিও মানসিকভাবে তুলনামূলক শক্ত অবস্থানে যা পরিবর্তন করা বেশ দুঃসাধ্য।
আবার এমনও হওয়া উচিত নয় যে, কঠোর আইন করে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করলাম কিন্তু মনোজাগতিক পরিবর্তনের চেষ্টা করলাম না। এতেও সার্বিক বিচারে কাজ হবে না। কারণ এতে তৃতীয় শ্রেণির মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণির মুখোশ পরে নেবে। পাশাপাশি সমাজের নানা প্রভাবকের সুযোগ নিয়ে যৌনাচারের মানসিকতা প্রকাশ করবে। এজন্য হুট করে কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে, রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান আশা করা দুরাশা বৈ কিছুই নয়। এ লক্ষ্যে প্রথমেই প্রয়োজন সার্বিক ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা (যড়ষরংঃরপ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয)।
ঘ. আমাদের চিন্তার চাইতেও বেশ বড় একটা অংশের ধারণা হলো- এ ইস্যুতে আমাদের সমাজকে পুরোপুরি পাশ্চাত্য সমাজের আদলে ঢেলে সাজালে হয়তো সমাধান সম্ভব। অর্থাৎ ফ্রি মিক্সিং; অবাধ যৌনাচারের স্বাধীনতা, যেখানে সম্মতিই চূড়ান্ত। সমাজের সবপর্যায়ে, শিশু থেকে বৃদ্ধ, গ্রাম থেকে শহর, অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রাখলে এ বিষয়টা হয়তো এতটা খারাপ পর্যায়ে যাবে না। কেননা এতে সকলেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। নারীসঙ্গ লাভের উগ্র বাসনা খুব একটা কাজ করবে না ফলে যৌনাচারের ভয়াবহতা কমে আসবে। আবার পাশ্চাত্যের ন্যায় পরস্পরের সম্মতিক্রমে যৌনাচার হলে তাতে অভিযোগ বা হয়রানির পথও বন্ধ হয়ে যাবে।
তাদের এ চিন্তা যদি এ সমস্যা সমাধানের জন্য হয় তাহলে অন্তত সমাধান চিন্তার জন্য তাদের ধন্যবাদ দেওয়াই যায়। তবে এটা অনেকটা পাগলদের মাঝে পাগল সেজে থাকার মতোই। সমস্যা হলো, পাগলের ভানকারী যে কোনো সময় তার আসল রূপে ফিরে যেতে পারে। যাই হোক, বহুবিধ কারণে এদেশে এমনকি সম্ভবত বিশ্বের সবখানেই এ পন্থা কার্যকর নয়। কারণ এ চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়। ফ্রি মিক্সিং হলেই যে সবাই আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে তা কিন্তু নয়। বরং সম্মতি না পেলে এর চাইতেও বেশি খারাপ অবস্থা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
-এ ধারণায় প্রথম শ্রেণির মানুষকে অস্বীকার করা হচ্ছে। অথচ সমাজের এই শ্রেণির মানুষের কারণে ফ্রি মিক্সিং সার্বজনীনতা পাবে না। গ্রহণীয় ও শালীনতার একটা মাপকাঠি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করবেই।
-এতে পাশ্চাত্যের আদলে আইন ও এর প্রয়োগকে খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। কিন্ত তাতে দ্বিতীয় প্রকার মানুষের অবস্থান পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। এজন্যই দেখা যায়, পাশ্চাত্যে লোডশেডিং হলে হাজার নারী ধর্ষিত হয়; কেননা সুযোগ সন্ধানীদের তখন আইন আর আটকাতে পারে না। কুমারী মায়েদের দুর্দশার কথা নাইবা বললাম। পাঠক একটু কষ্ট করলেই ইন্টারনেটে পাশ্চাত্যে ধর্ষণের পরিমাণ ও কুমারী মায়েদের অবস্থা সম্পর্কে ভূরিভূরি প্রমাণ পেয়ে যাবেন। উল্লেখ্য যে, এখনো মুসলিম দেশসমূহে ধর্ষণ ও নারী সহিংসতার হার অনেক অনেক কম। টুটাফাটা হলেও তা ইসলামী মূল্যবোধ আর ইসলাম অনুশীলনের ফল।
-সমাজের অন্যান্য প্রভাবকের (অশ্লীলতা, মিডিয়ার আগ্রাসন) ফলে মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের আধিক্য দেখা দেয়। এমনকি প্রথম শ্রেণির মানুষও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নেমে আসতে পারে।
সর্বোপরি, পাশ্চাত্যের আদলে করতে চাইলেও মনে রাখা উচিত খোদ পাশ্চাত্যই এ সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। যেখানে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ দুর্বল, ধর্ম নখদন্তহীন, সে সমাজে শুধু মানসিকতাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে এবং আইন করে ধর্ষণ রোধ করা যায় না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি তাকালে এ দৃশ্যই চোখে পড়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের তালিকায় আমেরিকা, ইংল্যা-, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া যেমন আছে তেমনই আছে ভারতও। অথচ বেশ ক’বছর আগেও এ তালিকায় ভারত ছিল না। কারণ সেখানে ধর্মের প্রভাব কিছুটা হলেও ছিল। মিডিয়ার অনাচার তা সফলতার সাথে দূর করে ভারতকে সেরা দশে ঠাঁই করে দিয়েছে।
এ ধারণার (ফ্রি মিক্সিং) আরো বড় একটা অসুবিধা হলো এতে আইনের সহজাত উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো জীবনকে সহজ করা। এক্ষেত্রে জীবন বলতে ব্যক্তি জীবন নয়; সামষ্টিক, সামাজিক। উদাহরণস্বরূপ, আইন না থাকলে কি হয় তা একবার ট্রাফিক আইন তুলে দিলেই বুঝা যাবে। জীবন কত কঠিন। ইসলামেও যেমন বলা আছে, কিসাস (হত্যার বিনিময়ে হত্যা) এর মধ্যে জীবন রয়েছে; তা হত্যাকারীর জীবন নয়, সমাজের বাকী জনগণের। অর্থাৎ হত্যাকারীকে হত্যা করা হলে বাকি জনগণ এ থেকে শিক্ষা নেবে এবং অপরকে হত্যা হতে বিরত থাকবে।
যাই হোক, অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে কঠোর আইন করলে তা অনেকটা ক্ষুধার্ত বাঘকে খাবার দেখিয়ে না দেওয়ার মতো হয়ে যায়। পাশ্চাত্যে ংবীঁধষ যধৎধংংসবহঃ কিংবা পযরষফ ধনঁংব ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইন খুব কঠিন। বিনা সম্মতিতে কিছু করলেই ংবীঁধষ যধৎধংংসবহঃ; পরিণতিতে- চাকরি, পেনশন-সম্মান সব শেষ।
এখন মানুষকে নানা প্রভাবক (খোলামেলা চলাফেরা, পর্ন সাইটের সহজলভ্যতা, মিডিয়ায় অশ্লীলতার সয়লাব) যখন সারাদিন উত্তেজিত করবে আর আইন তা ঠেকিয়ে রাখবে; তখন তা জীবনকে সহজ করে না বরং কঠিনই করে। যার ফলাফল সুযোগ পেলেই ঝাপিয়ে পড়া। তা হতে পারে নিজ দেশে, হতে পারে বিদেশে যুদ্ধক্ষেত্রের বন্দীদের নিয়ে। নিদেনপক্ষে তালাকের মাধ্যমে।
বাংলাদেশেও এমনই হচ্ছে। প্রভাবকের নিয়ন্ত্রণ না করে নারী বান্ধব আইন করে পুরুষরা যেমন নির্যাতিত হচ্ছে। তেমনই সুযোগের অবাধ ব্যবহারও ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের হার বাড়িয়েই তুলেছে। সুতরাং, এককেন্দ্রিক চিন্তা কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারছে না; কোনো দেশেই না, কোনো সময়েও না।
ঙ. এবার আসি এ প্রসঙ্গে ইসলামের বক্তব্য নিয়ে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলামই একমাত্র এ সমস্যায় সর্বাত্মক সমাধান প্রদান করেছে। ইসলাম শুধু মানসিকতার পরিবর্তনে হাত দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, দিয়েছে প্রভাবক আর উপাদানের ব্যাপারেও নির্দেশনা। পাশাপাশি শুধু নারীদের নয়, পুরুষদের দায়িত্ব কর্তব্যও নির্ধারিত করেছে, তিন শ্রেণির প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা কর্মপদ্ধতি বর্ণনা করেছে। ইসলামী আইনে মানসিকতার পরিবর্তনে শুধু মন-মানসের উপরই অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ চাপিয়ে দেয়নি; বরং মানসিকতা পরিবর্তনের প্রভাবক উপাদানগুলোর ব্যাপারেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। ইসলামে আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদান অনেকটা প্রতিষেধকের মতো। তার আগে রয়েছে প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। এতে শাস্তি দেওয়ার চাইতে পাপ না করার প্রতিই বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়। ইসলামের এ প্রক্রিয়া অনেকটা এমন- সমাধান=প্রতিরোধ [মোটিভেশন (ভয়-আশা), মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, প্রভাবকের নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ] + প্রতিষেধক (ব্যক্তিগত, সামাজিক)
[চলবে]
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়