1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা ও আত্মজিজ্ঞাসা
মোস্তফা মনজুর 
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২৩
ক.
ঘটনা-১ : বাইতুল্লাহ
আবূ বকর (রা.) মক্কার কাফিরদের সামনে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিলেন। খুতবার শুরুতেই কাফিররা আবূ বকর (রা.) কে প্রহার করে পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। প্রচÐ আঘাতের ফলে আবূ বকর (রা.) অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
অন্য সাহাবীরা তাঁকে বাড়িতে নিয়ে পৌঁছে দেন। দীর্ঘ সময় পর জ্ঞান ফিরলে আবূ বকর (রা.) সর্বপ্রথম জানতে চাইলেন- “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর কী অবস্থা? তিনি কোথায়?” বলা হলো, ‘তিনি ভালো আছেন, নিরাপদেই আছেন’। অতঃপর আবূ বকরের জন্য পানাহারের ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু লোকদের কথায় তাঁর মন প্রশান্ত হলো না। তিনি বললেন, ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ না করা পর্যন্ত কোনো খাবারই খাবো না’। হয়েছিলোও তা-ই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে না দেখা পর্যন্ত তিনি কিছুই মুখে তোলেননি।
ঘটনা-২ : উহুদের যুদ্ধ
বনূ দীনারের এক মহিলা সাহাবী দৌঁড়াচ্ছেন উহুদের পানে। পথিমধ্যে তাঁকে সংবাদ দেওয়া হলো যে তাঁর স্বামী, ভাই ও বাবা উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি ইন্নালিল্লাহ পড়ে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন, তাঁর কী অবস্থা?’ সবাই বললো, ‘তিনি ভালো আছেন। তুমি যেমন পছন্দ করো তিনি সে রকমই আছেন’। মহিলা বললেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দেখাও। আমি তাঁকে দেখে নিই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেই বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নিরাপদে আছেন, এটা দেখার পর আমার কাছে অন্য সব মুসীবত নিতান্তই তুচ্ছ। (সীরাত ইবন হিশাম)
আবূ বকর (রা.) নিজে রক্তাক্ত, অজ্ঞান ও একাকী উঠে বসতেও অক্ষম। এমতাবস্থায়ও তাঁর প্রথম কথাই ছিল, কেমন আছেন আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? কতটুকু প্রিয় হলে একজন ব্যক্তি তাঁর নিজের চিন্তা না করে অন্যের চিন্তা করেন! আমাদের ঈমান এমন পর্যায়ের যে, এ ধরনের ঘটনা বা আচরণ আমাদের কাছে অলৌকিক কিংবা রূপকথা মনে হয়। অথচ এমনই ছিল সাহাবাগণের নিত্যদিনের আচরণ।
আচ্ছা, আমরা কি কখনো জেনেছি, কেন আবূ বকর (রা.) নবী-রাসূলগণের পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ? অনেক সাহাবীই আমল, জ্ঞান, দান, জিহাদের বীরত্ব কিংবা দুনিয়া বিমুখতা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু সর্বোপরি হযরত আবূ বকর (রা.) হলেন উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। আর এর কারণ হলো- হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আবূ বকর (রা.) এর মতো আর কেউ ভালোবাসতে পারেননি। এজন্যই গোটা দুনিয়ায় প্রিয় কী জিজ্ঞাসা করলে আবূ বকর (রা.) বিনা দ্বিধায় বলেছিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! দুনিয়াতে আমার প্রিয় তিনটি বিষয় হচ্ছে, আপনার সামনে বসে থাকা, আপনার দিকে তাকিয়ে থাকা, আর আপনার জন্য আমার সম্পদ খরচ করা”। প্রিয় পাঠক, আশ্চর্যের কী আছে? যিনি ছিলেন হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বোত্তম নমুনা, তাঁর নিকট থেকে এমন উত্তর আসাটাই স্বাভাবিক নয় কি?
দ্বিতীয় ঘটনা একজন মহিলা সাহাবীর; অখ্যাত ও তৎকালীন আরবের বিশেষত্বহীন একজন সাধারণ নারীর। অথচ এই একটি ঘটনাই তাঁকে যে পরিমাণ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে; তা অকল্পনীয়। ভাবুন, জিহাদের ময়দানে তাঁর স্বামী শহীদ হলেন, ভাই-পিতা সকলই শহীদ হয়ে গেলেন। তিনি সামান্যতমও বিচলিত নন। তাঁর মূল চিন্তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে। কেমন আছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কোনো আঘাত তাকে স্পর্শ করেনি তো? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার পর তাঁর যে বক্তব্য- ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নিরাপদে আছেন, এটা দেখার পর আমার কাছে অন্য সব মুসীবত নিতান্তই তুচ্ছ’। এটাই প্রকৃত ভালোবাসা। দুনিয়ার সকল মানুষ থেকে, নিজ সত্তা থেকেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক ভালোবাসা। সুবহানাল্লাহ!!
প্রিয় পাঠক, শুধু এ দুটিই নয়। সীরাত ও ইতিহাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেমের এমন নযীর অসংখ্য। সাহাবাগণ ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এর যে নযীর রেখে গেছেন আজকের যুগে তা রূপকথার মতোই মনে হয়। আমাদের সম্ভবত নিজেদের দিকে তাকানো উচিত। ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এর দাবিদার হলে নিজেদের ভালোবাসা সাহাবাদের এসব নিক্তিতে তুলে মাপা উচিত। দেখা উচিত, এমন অবস্থায় পড়লে সাহাবীগণ কী করেছেন, আর আমরা কী করতাম।
খ.
প্রিয় পাঠক, ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের’ বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ঈমানের অঙ্গ। এটি না থাকলে যে ঈমানই থাকে না। এজন্য ইমাম বুখারী (র.) তাঁর সহীহ বুখারীতে একটি অধ্যায়ের শিরোনামই দিয়েছেন, حب الرسول من الايمان অর্থাৎ রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অংশ।
আল কুরআন ও হাদীসের অনেক স্থানেই ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
‘হে নবী বলে দিন, তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন এবং ধন-সম্পদ যা তোমরা উপার্জন কর, ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে লোকসানের আশঙ্কা করো আর ওই বাড়ি-ঘর যা তোমরা পছন্দ কর- এগুলো যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর নবী এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার তুলনায় বেশি প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক স¤প্রদায়কে হিদায়াত দান করেন না’। (সূরা তাওবাহ, আয়াত-২৪)
বস্তুত, ঈমানদারদের নিকট মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনকি তাঁদের নিজ জীবন অপেক্ষাও অধিক অগ্রগণ্য হবেন (সূরা আহযাব, আয়াত-৬) -এটাই ঈমানের দাবি। হাদীসে এসেছে,  নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কাছে আমি নিজ সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, এমনকি সমগ্র মানবজাতি অপেক্ষা প্রিয়তর হবো।’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। অন্য রিওয়ায়াতে আরো বর্ণিত আছে, ‘তার জীবন, তার সম্পত্তি এবং তার পরিবার (অপেক্ষা)।’
গ.
এবার আসা যাক, কেন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসবো? কিংবা ভালোবাসার জন্য কে সর্বাধিক উপযোগী? দুনিয়াতে মানুষের ভালোবাসার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে সৌন্দর্য, যোগ্যতা, অনুগ্রহ, ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা ইত্যাদি।
সৌন্দর্যের বিবেচনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন এ পৃথিবীর সর্বাধিক সুন্দর ব্যক্তি। সাহাবাগণ নানাভাবে তাঁর সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন। আবূ হুরাইরা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে সুন্দর কিছু দেখিনি। তাঁর চেহারায় যেন সূর্য চিকচিক করতো’। (শামাইলে তিরমিযী)
হযরত কা’ব ইবন মালিক (রা.) বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যখন আনন্দিত হতেন, তখন মনে হতো তাঁর চেহারায় এক টুকরো চাঁদ হাসছে’ (মুস্তাদরাক)। বা’রা ইবন আযিব (রা.) বলেন, ‘একদা পূর্ণিমা রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গেলাম। তিনি খোলা আকাশের নিচে চাদর গায়ে জড়িয়ে বসা ছিলেন। আমি আকাশের পূর্ণিমা আর নবীজির চেহারা বারবার দেখছিলাম। আমার কাছে মনে হলো, পূর্ণিমার সৌন্দর্য রাসূলুল্লাহর সৌন্দর্যের সামনে ম্লান হয়ে পড়েছে।’ এ স্বল্প পরিসরে প্রিয় নবীজির সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। শুধু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্যের আলোচনায় সাহাবাগণ যা বলেছেন সেগুলো উল্লেখ করলেই একটি পুস্তিকা হয়ে যাবে। বস্তুত নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন চাঁদের চেয়েও সুন্দর।
এবার আসি যোগ্যতার বিচারে। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলেই একমত যে, পূর্ণতম মানুষ ছিলেন আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অমুসলিম মাইকেল এইচ হার্ট সর্বকালের ১০০ জন শ্রেষ্ঠতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম সর্বপ্রথমেই উল্লেখ করেছেন। দু’চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া পাশ্চাত্য অমুসলিম বিশ্বেও এতে কোনো দ্বিমত নেই। আর সম্ভবত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যোগ্যতার সবচেয়ে বড় প্রমান আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা কলম, আয়াত-৪)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বলেছেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের নিমিত্তে জগতে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসনাদে আহমদ)
অনুগ্রহের বিবেচনায়ও বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠতম। স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছেন একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়’। (সূরা তাওবাহ, আয়াত-১২৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ইসলাম প্রচার করেই আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেননি, বরং হাতে কলমে ইসলাম পালনের উদাহরণ দিয়ে মেহেরবানী করেছেন। এজন্যই তো তিনিই ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’।
উম্মতের প্রতি তাঁর ভালোবাসাও ছিল অতুলনীয়। শুধু তাঁর সাহাবাদের জন্যই নয়, অনাগতকালের উম্মতের জন্যও তাঁর চিন্তা, মমত্ত¡ আর ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। প্রায় ১৪৫০ বছর পরের আজকের এই আমাদের জন্যও তাঁর ভালোবাসা আর উৎকণ্ঠার কথা বলে গেছেন। দুর্বল আর অদেখা বলে আমাদের ভুলে যাননি। ভুলে যাবেনও না কিয়ামতের সে কঠিন মুহূর্তে; সেদিন আল্লাহর সামনে তিনি ব্যতীত কেউই যে আর আমাদের পক্ষে দাঁড়াবে না; শাফাআত করার যোগ্যতাও যে আর কারো থাকবে না।
হে বন্ধু, এখনো কিসের এত দ্বিধা? কিসের এত সংশয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে ভালোবাসার উপলক্ষ্য? আর কারই বা সে যোগ্যতা আছে? সার্বিক বিচারে আমাদের রাসূলই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠতম, তিনিই তো শুধু পরিপূর্ণ ও নিখুঁত মানুষ। শেখ সাদী যা বলে গিয়েছেন অনেক পূর্বেই-
বালাগাল উলা বিকামালিহি,
কাশাফাদ্দুজা বিজামালিহি,
হাসুনাৎ জামিয়ু খিসালিহি,
সাল্লু আলায়হি ও আলিহি।।
“সুউচ্চ শিখরে সমাসীন তিনি নিজ মহিমায়
‘তিমির-তমসা কাটিলো তাঁর রূপের প্রভায়,
সুন্দর আর সুন্দর তাঁর স্বভাব চরিত্র তামাম
জানাও তাঁর ও তাঁর বংশের’ পরে দরূদ-সালাম।”
ঘ.
প্রিয় পাঠক, প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসতে পারি?
আমাদের সমাজে অনেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাব্বাতের দাবিদার। আমরা তাঁদের অস্বীকার করি না, আল্লাহ তাআলা তাঁদের সে নিআমত পূর্ণরূপে দান করুন। কিন্তু কষ্ট হয় তখনি, যখন দেখি ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এর দাবি করেও কেউ ইসলাম বিরোধী কাজ করে, প্রিয় নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের বিপরীত আমল করে কিংবা অমুসলিমদের অনুসরণে প্রবৃত্ত হয়।
জেনে রাখা উচিত, ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের’ শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং জীবনের সকল কথা, কাজ ও আচরণে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করাই হচ্ছে প্রকৃত ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। পাশাপাশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা, তাঁর জীবন ও আদর্শের প্রচার, তাঁর ও সুন্নাতের অবমাননার বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানো, প্রয়োজনে নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সুন্নাতের প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’।
আর আমাদের আজকের অবস্থা? শুধু কথাতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা; বেশি হলে সভা-সেমিনার, জশনে জুলুস পালন করেই শেষ। অথচ আমাদের জীবনে সুন্নত অনুপস্থিত; পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোথাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসার প্রকাশ নেই। বিধর্মী আর নাস্তিকদের অনুসরণই আমাদের ভালো লাগে; তাদের অনুকরণেই আমরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কী জবাব দেবো আল্লাহকে? কীভাবে উপস্থিত হবো নবীজির সামনে?
ঙ.
প্রিয় পাঠক, ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ শুধু কথাতেই নয় বরং কাজের মাধ্যমেই প্রকাশ করতে হয়। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা যে সব কাজ করা আবশ্যক সেগুলো হলো-
* সকল মানবের উপর রাসূল্ল্লুাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া।
* সকল ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আদব ও শিষ্টাচার রক্ষা করা।
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন, তা সত্য বলে প্রতিপন্ন করা।
* তাঁর ইত্তিবা ও আনুগত্য করা ও তাঁর হিদায়াতের আলোকে পরিচালিত হওয়া।
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের বিধান দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়া।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে অবস্থান নেয়া।
* উপযুক্ত বাক্য দ্বারা তাঁর প্রশংসা করা।
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা, ফযীলত, বৈশিষ্ট্য, মুজিযা ও সুন্নাহ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তাঁকে বেশি বেশি স্মরণ করা।
* শুধু ‘মুহাম্মাদ’ নামে তাকে উল্লেখ না করা, বরং এর সাথে ‘নবী’ বা ‘রাসূল’ সংযোজন করে সালাত ও সালাম পাঠ করা।
* মসজিদে নববীতে আদব রক্ষা করা, বিশেষ করে তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাওদার পাশে এসে স্বর উচ্চ না করা।
* হাদীসের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, হাদীস শোনার সময় ধৈর্য ও আদবের পরিচয় দেওয়া, হাদীস শেখার প্রতি অনুপ্রাণিত হওয়া।
* তাঁর প্রিয় সাহাবাদের ভালোবাসা ও তাঁদের পক্ষে অবস্থান নেয়া, তাঁদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ ও তাঁদের সুন্নাতের অনুসরণ করা।
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের প্রচার ও প্রসার করা।
পাশাপাশি কিছু কাজ ত্যাগ করাও ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ দাবি। যেমন –
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা হাদীস বানানো।
* বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ প্রত্যাখ্যান করা।
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আলোচনার সময় মনোসংযোগ না করা এবং আগ্রহের সাথে শ্রবণ না করা।
* সুন্নাহের অনুসারীদের ত্যাগ করা, তাঁদের গীবত করা ও তাঁদের উপহাস করা।
* নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য ও তার মু’জিযাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞান না রাখা।
* দ্বীনের মধ্যে নানা প্রকার বিদআত চালু করা।
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বাড়াবাড়ি।
* প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থাকা।
এখানে মাত্র কিছু কাজের ফিরিস্তি দেওয়া হলো। বস্তুত পরিপূর্ণভাবে সুন্নাহর অনুসরণই হলো প্রকৃত ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। সুন্নত না মেনে, বিজাতীয়দের অনুসরণ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসার দাবি করা মিথ্যা বৈ কিছুই নয়। প্রকৃত প্রেমিক তো সর্বাবস্থায় তার প্রেমাস্পদকে স্মরণ রাখে। আর ভাবে ‘এ অবস্থাতে আমার প্রেমাস্পদ কি করতেন বা কী পছন্দ করবেন’, অতঃপর সে অনুযায়ীই কাজ করে। আমরা যদি সত্যি নবীপ্রেমিক হই, তাহলে তা-ই করা উচিত যা তিনি পছন্দ করবেন। আর এরূপ আমলের জন্য নিজের বিবেকই সবচেয়ে বড় বিচারক।
চ.
একদা হযরত উমর (রা.) বলেছিলেন, ‘হুযূর! আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা সবকিছুর চাইতে বেশি; কিন্তু আমার প্রাণের চেয়ে বেশি নয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে উমর! তুমি তো এখনো মুমিন হতে পারনি।’ অতঃপর হযরত উমর (রা.) বললেন, ‘হুযূর! আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। তখন তিনি বললেন, ‘এখন তুমি মুমিন হয়েছ’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।
এখানেই আমাদের চিন্তার বিষয়। চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রশ্ন করি- আমি কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসি?
-আমার মা-বাবার চাইতে বেশি?
-আমার সন্তানের চাইতে বেশি?
-আমার স্বামী/স্ত্রীর চাইতে বেশি?
-আমার মাল-সম্পদ থেকে বেশি?
-আমার ইয্যত-সম্মান থেকে বেশি?
-দুনিয়ার সবকিছু থেকে বেশি?
এর কোনো একটি থেকেও যদি নবীজির ভালোবাসা কম হয়ে যায়, মনে রাখবেন, আপনার ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এর দাবি এখনো পূর্ণতা পায়নি।
হ্যাঁ, অনেকে হয়তো অন্তরে হ্যাঁ বলবেন। কিংবা বুঝতে পারবেন না মনের অবস্থা। এরূপ হলে প্রশ্নটি একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। নিজের সত্তাকে জিজ্ঞাসা করুন- যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাতিরে কুরবানী বা আত্মত্যাগের প্রশ্ন আসে আমি কোনটা কুরবানী করতে পারবো? যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতে উপরের সবকিছুই ত্যাগ করতে পারার অবস্থা সৃষ্টি হয়, তবেই আপনি ‘হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এর নিআমাত পূর্ণরূপে লাভ করেছেন।
পাঠক, দুনিয়ার জীবন তো শেষ হয়েই যাবে। কি নিয়ে হাযির হবেন প্রিয়তমের কাছে? কি জবাব দেবেন যদি তিনি দুনিয়ায় আমাদের কার্যকলাপ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেন? কিংবা যদি তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন? মাআযাল্লাহ, কোনো মুমিনই এমন অবস্থা চিন্তাও করতে পারে না। অতএব, সময় থাকতে সাবধান হওয়াই মঙ্গলজনক।
ছ.
শেষ করছি প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস দিয়ে। একদা একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কিয়ামত কবে হবে?’ এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, ‘যে কিয়ামতের অপেক্ষায় তুমি আছ, তার জন্য তোমার প্রস্তুতি কী?’ এ প্রশ্ন শুনে সাহাবী বেশ ঘাবড়ে গেলেন। অতঃপর বললেন, ‘কিয়ামতের জন্য আমার কোনো প্রস্তুতি নেই। কিন্তু আমার একটি জিনিস আছে, আর তা হচ্ছে, আল্লাহর হাবীবের প্রতি অন্তরের ভালোবাসা।’ সাহাবীর মুখে এ কথা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার অন্তরের সম্পর্ক যার সঙ্গে আছে, তোমার হাশরও হবে তার সঙ্গে’।
সুবহান আল্লাহ! কতই না উত্তম নবীজির সাথে হাশর। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকেই সে নিআমত দান করুন। আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল। আমীন। সুম্মা আমীন।
ফেইসবুকে আমরা...