হিন্দুস্তান বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক নামগুলির একটি। এর আক্ষরিক অর্থ “সিন্ধু নদের দেশ”। হিন্দুস্তান এসেছে আদি ফার্সি শব্দ ‘হিন্দু’ থেকে। ফার্সি ভাষায় সিন্ধু নদকে বলা হতো হিন্দু নদ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘স্তান’। ফার্সি শব্দে স্তানের অর্থ ‘জায়গা’। আগে হিন্দুস্তান বলতে গোটা উপমহাদেশকেই বুঝাতো। ঐতিহাসিকভাবে ‘হিন্দু’ কোনো ধর্মের নাম নয় বরং সিন্ধু নদের পাড়ে বসবাসরত মানুষদেরকে বুঝাতো, তারা যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন। অন্যদিকে বর্তমান হিন্দুধর্মের মূল নাম হচ্ছে সনাতন ধর্ম। কালের বিবর্তনে এখন হিন্দুধর্ম নামে পরিচিতি পেয়েছে। সারা বিশ্বের মুসলিমগণ অতীতে এই অঞ্চলকে “আল-হিন্দ বা হিন্দুস্তান” বলেই ডাকতেন এবং এখনও ডাকেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়েও এই উপমহাদেশকে বুঝানোর জন্য আল হিন্দ (الهند) নামটি ব্যবহৃত হয়েছে।
মুসলমানদের ভারত বিজয়
অখ- ভারত উপমহাদেশে বহিরাগত যেসব মুসলমান এসেছিলেন, তাদের তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ১. ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য এসে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন ২.পীর, দরবেশ, সূফী যারা শুধুমাত্র ইসলামের বাণী প্রচারের জন্যই আসেন এবং সারা জীবন এখানেই কাটান ৩. মুসলমান বাহিনী, তৎকালীন অত্যাচারী শাষক গোষ্ঠীর শোষণ ও জুলুম থেকে মজলুম জনগণকে মুক্তি ও দেশজয়ের আকাঙ্ক্ষায় বিজয়ীর বেশে ভারতবর্ষে মুসলমানরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়কালেই ইসলামের সুমহান বাণী ভারতবর্ষে এসে পৌঁছেছে। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকেই ভারতের পশ্চিম উপকূলে মালাবার রাজ্য তথা বর্তমান কেরালায় ইসলাম প্রচারিত হয়। মুসলিম ঐতিহাসিক শায়খ সায়নুদ্দীন তাঁর ‘তুহফাতুন নুজাহেদীন ফী বাযে আহওয়ালিল বারতাকালীন’ গ্রন্থে বলেন, ভারতের মালাবার রাজ্যের রাজা চেরুমল পারুমল স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে মক্কা গমন করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। (ড. কাজী দীন মুহম্মদ, বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ও ক্রমবিকাশ, আমাদের সূফীয়ায়ে কিরাম, পৃ.- ৩৩, গোলাম আহমদ মোর্তজা, ইতিহাসের ইতিহাস, পৃ.- ৭৭)। সেই যুগে মালাবারে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে এবং প্রায় দশটি মসজিদ নির্মাণ হয়। বিশ্বকোষ প্রণেতা বলেন, মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই এই অঞ্চলে মুসলমানদের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল তাতে সন্দেহ নাই। (বিশ্বকোষ, ১৪ পৃ.- ৬১৮, গোলাম আহমদ মোর্তজা, প্রাগুক্ত, পৃ.- ৭৮)। পরবর্তীতে খলীফা উমর (রা.) এর খিলাফতের শেষের দিকে ওমান থেকে ভারতে প্রথম অভিযান হয় (ড. ইশ্বরী প্রসাদ)। হযরত আলী (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.) এর সময়েও অভিযানের তথ্য পাওয়া যায়। (Sugata Bose & Ayesha Jalal, Modern South Asia: History, Culture, Political Economy, 2nd Ed. p. 17,21)
উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদের শাসনামলে ইরাকের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উদ্যোগে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সিন্ধু প্রদেশে মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে সিন্ধু প্রদেশ জয় করেন। এটা ছিল মুসলমানদের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক বিজয়। এরপর সুলতান মাহমুদ গজনবী ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত অভিযান করেন। সর্বশেষ শাহাবুদ্দীন নামে পরিচিত মুহাম্মদ মইজুদ্দীন ঘুরির মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী ও বৃহত্তর পরিসরে ভারতবর্ষে ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তি রচিত হয়। মুহাম্মদ ঘুরির সফল অভিযানের নেপথ্যে যেই আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে তিনি হচ্ছেন সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়ায মঈনুদ্দীন চিশতী (র.)। (সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী, ওমর আলী অনূদিত, সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, পৃ.-৩৩)
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর ভারত আগমনের ইতিবৃত্ত
চিশতিয়া তরীকার ইমাম খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) হিজরী ৫ম শতকের ৩য় দশকে মধ্য এশিয়ার খোরাসানের অন্তর্গত সানজার নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ খাজা গিয়াস উদ্দীন, মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা মাহেনূর। পিতৃকূল ও মাতৃকূল উভয় দিক থেকে তিনি আওলাদে রাসূলের অন্তর্ভুক্ত। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) ছিলেন আধ্যাত্মিক বুযুর্গ হযরত উসমান হারুনী (র.) এর মুরীদ ও খলীফা। মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) নিজ পীর ও মুর্শিদের অনুমতিক্রমে জ্ঞানী, গুণী, প-িত, দার্শনিকসহ অসংখ্য ওলীর সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি বাগদাদ শরীফে বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। এ সময় বড়পীর (র.) তাঁকে বলেছিলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে ও হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। একই সুসংবাদ তিনি নিজ পীর ও মুর্শিদ খাজা উসমান হারুনী (র.) এর সাথে মদীনা শরীফে অবস্থানকালে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে পেয়েছিলেন। খাজা মইনুদ্দীন চিশতী মাত্র ৪০ জন সফরসঙ্গীকে নিয়ে হিন্দুস্থানে আসেন। এরপর বিরতিহীনভাবে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেন। তিনি আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোরে পরে দিল্লী হয়ে আজমীরে আগমন করেন। আজমীরে পৌঁছালে সেই সময়ের অত্যাচারী হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। পৃথ্বীরাজ নানাভাবে তাঁকে উৎপীড়ন করার চেষ্টা করে। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) নিজেও জনগণের উপর পৃথ্বীরাজের অত্যাচার নির্যাতনে খুবই ব্যথিত ও অসন্তুষ্ট ছিলেন। পৃথ্বীরাজ এক পর্যায়ে তাঁর সাথে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ করলে তিনি এক টুকরো কাগজে লিখে পাঠান- ‘মান তোরা যেন্দা বদস্তে লশকরে ইসলাম বছোপর্দম’ অর্থাৎ আমি তোমাকে জীবিতাবস্থায়ই মুসলিম সেনাদলের হাতে সমর্পণ করলাম। ইতিপূর্বে মুহাম্মদ ঘুরি দুইবার (তাবাকাতে নাসেরি, তারিখে ফিরোজশাহী, তারিখে বাহাদুরশাহী ও তারিখে পৃথ্বীরাজ ইতিহাস গ্রন্থে সাতবার আক্রমণের কথা বলা হয়েছে) আক্রমণ করেও পৃথ্বীরাজের কাছে শোচনীয় পরাজয় লাভ করেছিলেন। মুহাম্মদ ঘুরি স্বপ্ন দেখেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) তাকে আজমীরসহ সমগ্র হিন্দুস্তান বিজয়ের সুসংবাদ প্রদান করে অভিযানের আহ্বান জানিয়েছেন। ঘুরি এরপরেই পুনরায় আক্রমণ করেন এবং বিজয় লাভ করেন। এভাবে দিল্লীসহ বিভিন্ন অঞ্চল বিজয়ের মাধ্যমে সমগ্র ভারতবর্ষে দিল্লী সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী সা¤্রাজ্যের সূচনা হয়। মুহাম্মদ ঘুরি ভারতে দিল্লীতে মুসলিম শাসনের রাজধানী বানিয়ে কুতুবুদ্দীন আইবেককে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এই সালতানাত ১২০৬-১৫২৬ পর্যন্ত ভারতবর্ষ শাসন করে। মুহাম্মদ ঘুরি খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর সাথে সাক্ষাত করে তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। (তারিখে ফিরিশতা, ১ম খ-, পৃ.- ৫৮, শেখ ফজলুল করিম, হযরত খাজা মুয়ীন উদ্দীন চিশতি জীবনচরিত, বাংলা একাডেমি, মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ, চেরাগে চিশতী, হাকীমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া পৃ.- ৪৬, মাওলানা আবুল হায়াত মুহাম্মদ তারেক, সুলতানুল হিন্দ মঈন উদ্দিন চিশতী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ.- ৪৬, ড. জহুরুল হাসান সারিব, মঈনুল হিন্দ, তাজ পাবলিশার্স, পৃ.- ৬৬)
ঐতিহাসিক ও প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ টি. ডব্লিউ আর্নল্ড, আরেক ঐতিহাসিক ইলিয়টের সূত্রে বলেন- ভারতে মুসলমান পীরদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান এবং ইসলাম প্রচারের অগ্রদূত হচ্ছেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.)। তিনি ছিলেন পারস্যের সিজিস্তানের অধিবাসী। তিনি হজ্জব্রত পালন উপলক্ষে মদীনায় গমন করলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে তাঁর নিকট আগমন করে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ হিন্দুস্থানকে তোমার হাতে ন্যস্ত করেছেন। সেখানে চলে যাও এবং আজমীরে গিয়ে বসতি গড়ো। আল্লাহর সাহায্যে তোমার এবং তোমার অনুসারীদের ধর্মানুরাগের দ্বারা সে দেশে ইসলাম বিস্তার লাভ করবে। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) সে আহবানে সাড়া দেন এবং আজমীরে যাত্রা করেন। তখন এ দেশটি ছিল হিন্দুদের শাসনাধীনে। দেশব্যাপীই মূর্তিপূজা প্রচলিত ছিল। তাঁর দ্বারা দীক্ষিতদের প্রথম হচ্ছেন একজন যোগী যিনি ছিলেন স্বয়ং রাজার ধর্মগুরু। ক্রমান্বয়ে তাঁর পাশে বিপুল সংখ্যক ভক্তের সমাবেশ ঘটে। একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিরাট সংখ্যক হিন্দুকে আজমীরের দিকে আকৃষ্ট করে। তিনি তাদের ইসলাম গ্রহণ করতে রাজী করান। আজমীরে আসার পথে তিনি একমাত্র দিল্লী শহরেই প্রায় ৭০০ লোককে ইসলামে দীক্ষিত করেন। (দি প্রিচিং অব ইসলাম, অনুবাদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১২, পৃ. ৩০৮ )
ইসলাম প্রচারে অবদান
দিল্লী ও আজমীরে মুসলিম শাসন কায়িম হবার পর মধ্যপ্রাচ্যের বহু সূফী সাধক ভারতবর্ষে এসে ইসলাম প্রচারের মানসে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন। তাদের অনেকেই খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর সাথে সাক্ষাত করে তাঁর দুআ ও অনুমতি নিয়ে দূর দূরান্তের এলাকাসমূহে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকে। অপরদিকে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী তাঁর মুরীদদের মধ্যে বিশেষ তালিমপ্রাপ্ত ও জ্ঞানী মুরীদগণকে তরীকার খিলাফত প্রদান করে বিভিন্ন এলাকায় পাঠাতে থাকেন। উত্তর ভারত ও মধ্য ভারতের এমন কোন জনপদ ছিল না যেখানে তাঁর খলীফা পদার্পণ করেননি। এমনকি তৎকালীন বঙ্গদেশেও তাঁর খলীফাদের আগমন ঘটেছিল। এদেরই একজন সৈয়দ আবদুল্লাহ কিরমানী। ইনি বীরভূমে প্রচারকেন্দ্র গড়ে তুলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় বহু খলীফা প্রেরণ করেছিলেন। মোট কথা, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী একটা সর্বভারতীয় মিশন গঠন করে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। এ মহান মুবাল্লিগের প্রচেষ্টার ফলেই ভারতে ইসলামের সূর্য উদিত হয়েছিল এবং লক্ষ লক্ষ অন্য ধর্মাবলম্বী ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে শরীআত ও মারিফতের পরম সুধা পানপূর্বক জীবনের উৎকর্ষ সাধন করেছিল। কারো মতে আশি লক্ষ, আবার কারো মতে নিরানব্বই লক্ষ। (জিহাদুল ইসলাম ও ড. সাইফুল ইসলাম, দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন, অনুবাদ, পৃ.- ৫১৯) শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া (র.) সহ অনেকের মতে, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর কাছে ৯০ লক্ষ লোক ইসলাম গ্রহণ করে। (তারীখে মাশায়িখে চিশত, অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ.- ১৩৫) এনাম্যারি শিমেল বলেন-ভারতবর্ষে সর্ববৃহৎ আকারে ইসলামের প্রচার প্রসারে অগ্রনায়ক হচ্ছেন খাজা মঈনুদ্দীন হাসান চিশতী। যিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেন এবং এর পরেই মইজুদ্দীন ঘুরি দিল্লী বিজয় করে দিল্লী ইসলামী সালতানাতের সূচনা করেন। (Annemarie Schimmel, Islam in the indian Subcontinent, 1980, p.-23)
সায়্যিদ আবুল হাসান নদভী, সিয়ারুল আউলিয়া ও মাআছারুল কিরাম গ্রন্থদ্বয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “ভারতবর্ষ নামক দেশটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কুফর ও শিরকের রাজত্ব ছিল। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ ইট পাথর, গাছ-গাছড়া, পশু-পাখি, চন্দ্র-সূর্য, গোবর-বিষ্ঠা ইত্যাদির পূজা করে প্রণতি জানাতো। এরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন স¤পর্কে ছিল বেখবর। ‘আল্লাহু আকবার’ আওয়াজ কেউ কোনদিন শোনেনি। আফতাব-ই-হিন্দ বা ভারতসূর্য খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতির পবিত্র কদম এদেশের মাটিতে পড়া মাত্রই অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীভূত হয়ে শেরেকের কালো প্রতীক অবনমিত হয়ে তৎস্থলে খানকা, মসজিদ, মেহরাব ও মিম্বার থেকে আল্লাহু আকবার ধ্বনি কর্ণ কুহরে প্রবেশ করতে থাকে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ভারতীয় উপমহাদেশের উপর চিশতিয়া সিলসিলার মহান বুযুর্গ ও মনীষীদের চিরন্তন দাবি ও অধিকার রয়েছে। এ দেশে যারাই ঈমান ও ইসলামের মহামূল্যবান স¤পদের অধিকারী হয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত হবেন এবং তাদের অধস্তন বংশধরগণ সবাই খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর আমলনামার অন্তর্ভুক্ত। ভারতবর্ষে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেতে থাকবে তার সাওয়াব শায়খুল ইসলাম খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর রূহ মুবারকে ততই পৌঁছতে থাকবে। (সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী, উমর আলী অনূদিত, সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, পৃ. ৩৩)
আদর্শ ও দর্শন
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর মিশন ছিল যালিমের বিপক্ষে মযলুমের মুক্তির সংগ্রাম। বিপুল সংখ্যক ধর্মান্তরের এই ঐতিহাসিক বিপ্লব জোরজবরদস্তি বা আরোপিত ছিল না বরং তাঁর দাওয়াতি নীতি ছিল ইসলামের শ্বাশত আদর্শ, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ভিত্তিতে সমুজ্জ্বল। ফলে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি ও নীতি আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ ইসলামকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে। এনাম্যারি শিমেল বলেন, ‘খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর সূফী তরীকার মূলনীতি হলো সকলের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য। বিশেষ করে গরীব ও অভাবীদের সহযোগিতা করা।’ (Annemarie Schimmel, Islam in the indian Subcontinent,1980, p.-24)
প্রাচীন ঐতিহাসিকগণের মতে, মুহাম্মদ ঘুরি কর্তৃক ভারতবর্ষের মহাবিজয়ে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর দুআ, তাওয়াজ্জুহ ও আধ্যাত্মিক শক্তির এক বিরাট ভূমিকা ছিল। মোল্লা আবদুল কাদের বদায়ূনী বলেন- এই বিজয় হযরত কুতুবে রব্বানী খাজা আজমিরী এর বরকতে হয়েছে (তাবাকাতে নাসিরী, পৃ.- ৪০, তারিখে ফিরিশতা, পৃ.- ৫৭, মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ পৃ.- ৫০, ৫৮)। মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর মাধ্যমে উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের সফলতার ব্যাপ্তি ও এই অঞ্চলে তাঁর দর্শনের সামাজিক প্রভাব এতোটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন বলেন- ‘‘The personality of the Great Khwaja was standard of greatness and excellence, today His Shrine carries the same standard. It is an undeniable fact that in India His Shrine virtually rules.’’ (২০শে ডিসেম্বর, ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে পাশকৃত ৬ষ্ঠ রিপোর্ট তথা DURGAH KHAWJA SAHEB, AJMER ২(৯) ও ২(১০) নং অনুচ্ছেদেও উল্লেখ আছে)।