৭ম শতাব্দীর ২য় দশকে আইবেরিয়া উপদ্বীপ তথা বর্তমান স্পেন এবং পর্তুগাল জয় ছিল মুসলিমদের এক ঐতিহাসিক বিজয়। সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের জয় করা স্পেনকে মুসলমানরা নামকরণ করেছিল ‘আন্দালুসিয়া’। ‘আন্দালুস’ শব্দটি আরবী। যার অর্থ- গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে সবুজের সমারোহ। রাজধানী ছিল কর্ডোভা।
মুসলমানদের হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বলতম কেন্দ্র ছিল স্পেন। দীর্ঘ সাতশত বছর স্পেন মুসলমানদের অধীনে ছিল। ইউরোপের বুকে একমাত্র মুসলিম ভূখ- ছিল বলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ স্পেন অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয় রেঁনেসার উন্মেষে অনবদ্য অবদান রেখেছে। মুসলিম স্পেন যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চায় নিমগ্ন তখন ইউরোপ অজ্ঞতা-বর্বরতায় নিমজ্জিত। লেনপুল উল্লেখ করেছেন, তখন গোটা ইউরোপ বর্বর অজ্ঞতা ও বুনো ব্যবহারে নিমজ্জিত ছিল।
ইউরোপীয়রা মুসলমানদের হাত হতে যখন স্পেন ছিনিয়ে নেয় তখন হতেই প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় রেঁনেসার সূত্রপাত হয়। মুসলিম স্পেন একটা উন্নত সভ্যতার পাদপীঠ ছিল। বিজ্ঞান চর্চা, শিল্প সাধনা এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে তাঁরা এমন এক স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, তাদের ছাড়া সভ্যতার ইতিহাস অপূর্ণাঙ্গ রয়ে যায়। মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও নবী মুহাম্মদ এর শিক্ষার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম দুনিয়া সর্বক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করে। বাগদাদ, কনস্টান্টিনোপল, কর্ডোভায় মুসলিম উৎকর্ষতার চরম বিকাশ লাভ করে। তদানীন্তন বিশ্বে বাগদাদ, কনস্টান্টিনোপল ও কর্ডোভাই ছিল বিশ্বের সভ্যতার পীঠস্থান। কিন্তু কর্ডোভার সভ্যতা যেন সবাইকে অতিক্রম করেছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে কর্ডোভার খ্যাতি ছিল বিশ্ববিখ্যাত। কর্ডোভার সভ্যতা আর জ্ঞানশিখা সমগ্র ইউরোপ গগনে রবি রশ্মির ন্যায় বিকীর্ণ হতো।
গোটা স্পেনই ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার এক আদর্শভূমি। প্রত্যেক শাসকই ছিলেন জ্ঞানানুরাগী বিদ্যোৎসাহী। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে স্পেন এমন এক স্বর্ণদ্বারে পরিণত হয়েছিল। ফ্রান্স, ইতালি, গ্যালিসিয়া, আফ্রিকা, সিরিয়া, মিশর, ইরাক, পারস্য প্রভৃতি দূর দেশ হতে ছুটে আসত বিদ্যাভূষণ প-িত প্রবর কবি-সাহিত্যিকগণ। তাঁরা সকলেই এখানে সমাদরে অভ্যার্হিত এবং সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত হতেন। প্রতিভা পূরণের সুযোগ পেয়ে বহু বিখ্যাত কবি, বৈয়াকরণিক এবং ঐতিহাসিকরা কর্ডোভায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। দার্শনিক মাইকেল স্কটও উচ্চ শিক্ষার জন্য স্পেনে এসেছিলেন।
কর্ডোভাতেই ছিল ২০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭০টি কলেজ এবং ৭০টি পাবলিক লাইব্রেরি। খলীফা মুনতাসির নি¤œবিত্তদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য স্থাপন করেন অবৈতনিক ২৭টি বিদ্যালয়। স্পেনে যখন প্রায় প্রত্যেকেই লেখাপড়া জানত তখন খ্রিষ্টান ইউরোপে গুটিকয়েক পুরোহিত ব্যতীত অন্যরা ছিল নিরেট মূর্খ।
কুরআন, আরবী ব্যাকরণ ও কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে স্পেনে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতো। তাফসীর, ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, আরবী ব্যাকরণ, অভিধান শাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসা প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ধর্ম ও আইনশাস্ত্র বিভাগ নিয়ে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ বিষয়গুলো ছাড়াও রসায়ন ও দর্শন বিভাগ ছিল গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। কারিগরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, বক্তৃতা চর্চা ছিল এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান সমান অধিকার নিয়ে শিক্ষাগ্রহণ ও পাঠদানে নিয়োজিত থাকত। নবম শতাব্দীতে একমাত্র কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল এগারো হাজার।
স্পেনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিপুল তথ্য জানা যায় সেখানকার শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানীদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ এবং বিশ্বখ্যাত লাইব্রেরিসমূহের বহর দেখে। কাসিরির মতে, শুধু কর্ডোবাতেই ১৭০ জন শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল। এখানকার বিজ্ঞানী ইবনুল খাতিব বিভিন্ন বিষয়ে একহাজার একশ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ইবনুল হাসান চারশত আর ইবনুল হাইসামের পা-ুলিপির সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। এক একটি অভিধান সমাপ্ত হতো ৪০-৫০ খণ্ডে। ইবনে হাবিব একহাজার, আব্দুল মালিক একহাজার, ইবনুল হাইসাম চারশটি, ইবনে হান চারশটি, ইবনে ইবান ও হুনায়েন ১০০টি, ইবনে হাইয়ান ৬০টি গ্রন্থ লিখেন।
স্পেনের প্রত্যেকটি শহরেই ছিল সরকারি গ্রন্থাগার ও সাধারণ পাঠাগার। গৌরবময় যুগে সেখানে ৭০টি সাধারণ গ্রন্থাগার ছিল। এতে রক্ষিত ছিল লক্ষ লক্ষ গ্রন্থ ও পা-ুলিপির সংগ্রহ। ব্যক্তিগত লাইব্রেরি সে যুগে এক প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। মন্ত্রী ইবনে আব্বাসের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে চার লক্ষ বই ছিল। সুলতান হাকামের পুস্তক তালিকা ৫০ খ-ে বিভক্ত ছিল। সাধারণ লোকদের গ্রন্থাগারে থাকত অজস্য গ্রন্থের সমাহার। ইবনুল আসরানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে দশ হাজার, ইয়াহুদী চিকিৎসক দুনাশবেন তামিনের লাইব্রেরিতে ২০ হাজার পুস্তক ছিল। যখন ইউরোপের বৃহত্তম লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০০টি।
এরপরের ইতিহাস বড়ই করুণ! বড়ই নির্মম! আমরা ডুবে গেলাম বিলাসিতার মহাসমুদ্রে। প্রিয় কুরতুবা! আল হামরা মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন হয়ে এখনো দাড়িয়ে আছে স্পেনে। রাস্তার পাশের গির্জার আকাশচুম্বী মিনারগুলো যদি কথা বলতে পারত, মানুষের মত দুঃখে কান্না করতে পারত, তাহলে হয়তো আমরা বুঝতে পারতাম যে, সেগুলো গির্জা নয়, আল্লাহর ঘর মসজিদ। এককালে এখানে সিজদায় লুঠিয়ে পড়েছিল কত পুণ্যাত্মা, কত ওলী, দরবেশ।
১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি আল-আন্দালুস আমাদের হাতছাড়া হয়। ক্রুসেডের ফলে আধুনিক ইউরোপ জন্মলাভ করে। খ্রিষ্টানরা স্পেন থেকে বসবাসরত মুসলমানদের নারকীয়ভাবে হত্যা ও বিতাড়িত করে এবং মুসলিম সভ্যতার স্থাপত্য নিদর্শনাবলি দখল করে নেয়। মুসলিমদের এই ভূখ-টি ধীরে ধীরে খ্রিষ্টান রাজ্যে পরিণত হয়। শেষ হয়ে যায় ৮০০ বছরের ইসলামী আল আন্দালুস রাষ্ট্রের। আহ আন্দালুস! আমাদের হারানো ফিরদাউস!