1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
আওরঙ্গজেবকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি
ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক
  • ৬ মার্চ, ২০২১

হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করতে কোনো কোনো হিন্দু শাসকের অনৈতিক কার্যকলাপকে আড়াল করতে ইতিহাস বিকৃতি করে চলেছেন। একেই বলা যেতে পারে পুকুরচুরি। এটি একটি ভয়ঙ্কর খেলা। মুসলমানদের একজন প্রখ্যাত শাসক আওরঙ্গজেব আলমগীর সম্পর্কে এই সম্প্রদায়ের ইতিহাসবিদগণ মিথ্যাচারের আশঙ্কা করেছেন। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু ভালো মানুষ এই ধরনের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। পশ্চিমবঙ্গের সুরজিৎ দাশ গুপ্ত তার ভারতীয় মুসলমানদের সংকট (প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ, পৌষ ১৪০৯) গ্রন্থে মিথ্যাচারের সমালোচনা করে স্বচ্ছতার প্রকাশ করেছেন। মুসলমান শাসকরা যে দানব নন, আর হিন্দু শাসকরা যে সবাই দেবতা নন, তাই তিনি বলেছেন।
আওরঙ্গজেবকে নিয়ে মিথ্যাচার
সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেন, অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্ট্রি’র ঐতিহাসিকরাও মন্তব্য করেছেন যে ঐতিহাসিকগণ মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের মূল্য নিরূপণে বিশেষ রকম কঠিন সমস্যায় উত্তেজিত। তাঁরা ইঙ্গিত করেছেন যে, যেভাবে আওরঙ্গজেব দিল্লির মসনদ দখল করেন তা তাঁর প্রতি ঐতিহাসিকদের বিরূপ করে। কিন্তু বিম্বিসার এবং অজাতশত্রুর ইতিহাস প্রণয়নের সময় একই ঐতিহাসিকগণ ঘটনাবলিকে কোমল বর্ণে রঞ্জিত করেন। অজাতশত্রু শুধু পিতাকে হত্যাই করেননি, পিতার প্রিয় ধর্মকেও নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং কবির ভাষা সত্য বলে ঘোষণা করেছিলেন বেদ, ব্রাহ্মণ, রাজা ছাড়া আর কিছু নাহি ভবে পূজা করিবার। পিতাকে বন্দী করে আওরঙ্গজেব কি অজাতশত্রুর চেয়েও অপরাধ করেছিলেন? একজন খাঁটি সুন্নী মুসলিম হিসেবেই তিনি মদ, ভাং ইত্যাদি নেশা নিষিদ্ধ করেছিলেন। বাইজিদের উপর হুকুম জারি করেছিলেন যে বিয়ে না করলে দেশ ছাড়তে হবে। অশ্লীল আমোদ-প্রমোদ বন্ধ করেছিলেন। সতীদাহ প্রথাও নিষিদ্ধ করেছিলেন। এই সব আদেশ ও ফরমানের পেছনে যে মানসিকতা প্রকাশ পায় তাকে কি এক কথায় অন্যায় অথবা সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করা যায়? তিনি ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে জিজিয়া কর প্রবর্তন করেছিলেন বলে নিন্দিত। নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে শাসনকর্তা একটা কর আদায় করবেন মুসলমান হলে করটার নাম যাকাত আর অমুসলমান হলে জিজিয়া। এটাই শাসননীতি। মুসলমান কর দেবে আর ব্রাহ্মণ ছাড় পাবে আওরঙ্গজেব মুসলমান অমুসলমানের এই বিভেদটা তুলে দেওয়ার জন্যই জিজিয়া কর চালু করেছিলেন। কিন্তু এজন্যই পরবর্তী যুগের বহু ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবকে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির অপরাধে অভিযুক্ত করেছেন।
সুরজিৎ লেখেন, আওরঙ্গজেবের প্রতি আর একটা বড় অভিযোগ এই যে, তিনি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন। এটা সত্য যে তিনি একাধিক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও সত্য যে তিনি একাধিক হিন্দু মন্দির নির্মাণের জন্য অথবা পূর্ব নির্মিত মন্দিরের বিগ্রহের সেবা ও ভোগের জন্য জায়গীর দানের ফরমান জারী করেছিলেন। বারনসীতে তিনি শিব মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এটা সর্বজনবিদিত, কিন্তু এই বারানসীতেই তিনি যে জঙ্গেমবাদী মঠের জন্য অর্থ ও ভূমি দান করেছিলেন তা গবেষক সমাজের বাইরে অজ্ঞাত। বলা হয় যে আওরঙ্গজেবের সাম্প্রদায়িকতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হল বারনসীর বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস। কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং কাদের অনুরোধে বা দাবিতে তিনি এই বিখ্যাত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন তার বিবরণ ও বিশ্লেষণ ড. পট্টভি সীতা রামাইয়া দিয়েছেন ‘দি ফেদারস এন্ড দি স্টোনস’ নামক গ্রন্থে। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই আওরঙ্গজেব যখন তাঁর দলবল নিয়ে বারানসীর কাছ দিয়ে বাংলার দিকে এগুচ্ছিলেন তখন তার বাহিনীর অভিজাত হিন্দুরা তাঁকে বলেন যে তিনি যদি সেখানে দু একদিন বিশ্রাম নেন তাহলে তাঁদের রাণীরা গঙ্গায় স্নান করে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুঁজো দিতে পারেন। বাদশাহ রাজি হন। কিন্তু গঙ্গা স্নান করে মন্দিরে পুজো দেওয়ার পরে রাণীদের একজনকে পাওয়া গেল না। খবর পেয়েই আওরঙ্গজেব তাঁর কয়েকজন হিন্দু রাজাকে পাঠালেন নিখোঁজ রাণীর সন্ধানে। মন্দিরে ঢুকে খুঁজতে খুঁজতে তারা নারী কণ্ঠের আর্তনাদের উৎস ধরে এক গণেশ মূর্তির পেছনে ওপ্ত সুড়ঙ্গপথ দেখতে পেলেন। তারা ত্বরিতে গিয়ে সেই রাণীকে নিচের ওপ্ত কক্ষ থেকে উদ্ধার করলেন। স্বয়ং প্রভু বিশ্বনাথের বিগ্রহের ঠিক নিচেই ছিল সেই ওপ্ত কক্ষ। ক্ষুব্ধ রাজাদের দাবিতে আওরঙ্গজেব পবিত্র বিগ্রহ অপসারণ করে ওই অপবিত্র মন্দির চূর্ণ করার আদেশ দিলেন। বাদশাহের হুকুম তামিল হল। তখন কেউ ভাবেনি যে একশ বছর পরে এই ঘটনাটিকে আওরঙ্গজেবের হিন্দু বিদ্বেষের ও মন্দিরের ধ্বংস বৃত্তির অকাট্য প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং তিনি বিচূর্ণ মন্দিরের স্থানে যে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সেই মসজিদ ভেঙ্গে নতুন আরও একটি বিশ্বনাথ মন্দির নির্মাণের জন্য আন্দোলনের আহ্বান জানানো হবে। এটাও বলে রাখা ভালো যে, বিরুদ্ধ বা শত্রু পক্ষের উপর বিজয়ের চরম ঘোষণা হিসেবে সেই বিজিত এলাকার মন্দির বা মসজিদ ধ্বংস করা সে আমলে একটা প্রথা ছিল- সেই প্রথা থেকেই মহারাষ্ট্রীয়রাও বিজিতের ধর্মস্থান ধ্বংস করেছে এবং আওরঙ্গজেব গোলকোন্ডার তানাশাহর মসজিদ ধ্বংস করেছেন। (পৃ. ২০-২১)
বারা নসির বিশ্বনাথের মন্দিরে হিন্দু রাণীর উপর বলাৎকার হয়েছিল বলেই আওরঙ্গজেবের হিন্দু রাজা ও সেনাপতিগণ সেই অপবিত্র মন্দির ভাঙ্গার দাবি তোলেন। বাদশাহ তাদের দাবি মানাতে দোষী হয়ে গেলেন? মন্দিরে যে নারীদের নিয়ে এসব হয় তা তো ঠিক। দেবদাসীদের তো মন্দিরের গণিকা হিসেবে রাখা হতো। আওরঙ্গজেব বিশ্বনাথ মন্দিরের বিগ্রহ ধ্বংস করেনি তা সরিয়ে নেওয়া হয়। শুধু নারীর উপর বলাৎকারের জায়গা মন্দিরটিকে রাজাদের দাবি অনুযায়ী ধ্বংস করা হয়।

ফেইসবুকে আমরা...