1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
পশ্চিমবঙ্গে ভোট ও আব্বাস সিদ্দিকীর সেক্যুলার ফ্রন্ট
রহমান মোখলেস
  • ১ মার্চ, ২০২১

আগামী এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ ভারতের পাঁচ রাজ্যের বিধান সভার ভোট। ইতোমধ্যেই ভোটের রাজনীতিতে সরব হয়ে ওঠেছে রাজ্যগুলো। তেতে উঠছে রাজনীতির মাঠ। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের ভোটের মাত্রায় এবার যোগ হয়েছে নতুন সমীকরণ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের দিকে সবার দৃষ্টি। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের ভোটের রাজনীতিতে মুসলিম ভোট গুরুত্বপূর্ণ। এবারও মুসলিম ভোট নিয়ে শুরু হয়েছে বিভিন্ন দলের নানা তৎপরতা। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট আছে। আর এই মুসলিম ভোটের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে কোন দল ক্ষমতায় যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি বিধানসভা আসনে নির্বাচন হওয়ার কথা।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সাল থেকে পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায়। দুই বারেই মুসলমানরা ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাংক। এর আগে যখন বাম জোট ক্ষমতায় ছিল, তখন বাম জোটের ভোটব্যাংক ছিল মুসলমানরা। এছাড়া কংগ্রেসও মুসলমানদের কিছু কিছু ভোট পেয়ে এসেছে। কিন্তু এবার মুসলিম ভোট নিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল শঙ্কায়। মমতা জন্য আতঙ্কের খবর হলো, রাজ্যের মুসলিম ভোটব্যাংকে এবার ভাগ বসাতে পারেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। আব্বাস সিদ্দিকী গত ২১ জানুয়ারি ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ নামে একটি নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আব্বাস সিদ্দিকী তাঁর ভাই নৌশাদ সিদ্দিকীকে এই দলের চেয়ারম্যান করেছেন। একই সঙ্গে তিনি দলীয় পতাকার আবরণ উন্মোচন করেন এবং ঘোষণা দেন ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ পশ্চিমঙ্গের বিধান সভার নির্বাচনে লড়বে। পিছন থেকে সেই দলের পৃষ্ঠপোষকতা করবেন তিনি।
আব্বাস সিদ্দিকী বলেছেন, ‘৭৪ বছর ধরে এ রাজ্যের দলিত ও সংখ্যালঘু মানুষকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, সংসদীয় রাজনীতিতে এসে এইসব অসহায় মানুষের হয়ে আওয়াজ তোলা। আর সেজন্যই দল গড়েছি।’

কে এই আব্বাস সিদ্দিকী
পশ্চিমবঙ্গের ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব আবূ বকর সিদ্দিকীর অধস্তন পুরুষ আব্বাস সিদ্দিকী। তার চাচা ত্বহা সিদ্দিকী এতদিন তৃণমূলকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকী নতুন দল গঠনের পর সরাসরি নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ৪৪টি আসনে প্রার্থী দিতে চান তিনি। এতে বেড়েছে মমতার অস্বস্তি, বেড়েছে শঙ্কাও। ত্বহা সিদ্দিকী এতদিন মমতাবিরোধী কোনো কথা বলেননি। কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকী বেশ কিছুদিন ধরেই মমতাবিরোধী মন্তব্য করে চলছেন। এদিকে সম্প্রতি আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করেছেন এমআইএম (মিম) প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েইসি। আসাউদ্দিন ভারতে মুসলিম রাজনীতির জন্য জনপ্রিয়। বিহারের গত নির্বাচনে ওয়েইসির দল পাঁচটি আসন লাভ করে। বিহারে সাফল্য পাওয়ার পরে হায়দ্রাবাদের এই রাজনীতিক আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে পশ্চিমবঙ্গেও ভোটে লড়তে চাইছেন। আসাউদ্দিন ওয়েইসির দল অল ইন্ডিয়া মজলিশে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এমআইএম) বা সংক্ষেপে মিম। হায়দ্রাবাদ ভিত্তিক এই দলটি এতদিন তেলেঙ্গানা রাজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও দলটির বিস্তার ঘটছে।
নতুন দল ঘোষণা করে আব্বাস সিদ্দিকী বলেছেন, মুসলিম-দলিত-আদিবাসীদের স্বার্থে কাজ করবে তার দল। আপাতত উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও হুগলিকে কেন্দ্র করে কাজ শুরু করবে ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট। দলটি রাজনৈতিক সমঝোতা করতে রাজি যেকোনো দলের সঙ্গে। শুধু বিজেপি নয়, ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও আসাউদ্দিন ওয়েসির দল মিম এর সঙ্গে তাদের কথাবার্তা এগিয়েছে। তবে ফুরফুরা দরবার শরীফের এই পীরজাদা নিজে ভোটে লড়বেন না। তিনি জানান, ‘আমি কিং হতে চাই না, কিংমেকার হব।’
আব্বাস বলেন, ‘তার দলের সঙ্গে কারা যুক্ত হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে আমরা একটা মহাজোট চাই। এই মহাজোটে যারা আসবেন না, তারা আমাদের প্রতিপক্ষ।’ আব্বাসের মতে, ‘এ রাজ্যে বিজেপি সক্রিয় ছিল না। মমতাই তো বিজেপিকে নিয়ে এসেছে।’

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের নানা সমীকরণ
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ফুরফুরা শরীফ বরাবরই আলোচিত বিষয়। ভোটের আগে এখানকার পীরজাদারা মুসলিমদের কাকে ভোট দেওয়া উচিত, এই মর্মে নানা মন্তব্য করেন। আর এবার দল গঠন করে সরাসরি নির্বাচনের মাঠে। নির্বাচনে নতুন এই মেরুকরণে শঙ্কায় স্থানীয় মুসলমানেরাও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের বক্তব্য, আব্বাস সিদ্দিকীর পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন দল হওয়ায় মুসলিম ভোটব্যাংকের একটি বড় অংশ তৃণমূলের থেকে সরে যাবে। তৃণমূলের ভোট কাটবে। যা বিজেপির জন্য সুবিধাজনক হবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বক্তব্য, পিছন থেকে আব্বাসকে উসকে দিচ্ছে বিজেপি। আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে এক সময় মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মুকুল রায় তখন তৃণমূলে। এখন মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে এমন কথা চাউর রয়েছে যে, আব্বাস সিদ্দিকীকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন মুকুল রায়। অবশ্য আব্বাস সিদ্দিকী সে কথা মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ আছে। আর তাঁর রাজনীতি যতটা তৃণমূলবিরোধী, ঠিক ততটাই বিজেপিবিরোধী।
সম্প্রতি আব্বাস সিদ্দিকী ডয়েচে ভ্যালেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে ধর্মনিরেপক্ষতার নাম করে বহু রাজনৈতিক দল সামনে এসেছে। কিন্তু গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সবাই বঞ্চিত। মুসলিম, দলিত, আদিবাসীরা তো বটেই, হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় অংশের মানুষও পিছিয়ে আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য কোনো দিক দিয়েই পরিষেবা পান না। তাঁরা অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠ হয়ে ওঠাই হবে তাঁর দলের লক্ষ্য। শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকারগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবে তাঁর দল।’

বিজেপির জন্য পোয়াবারো
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে এবার ধর্মীয় মেরুকরণের নির্বাচন হবে। বিজেপি ধর্মীয় তাস খেলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার উত্তর দিতে গিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ বৃদ্ধি করছেন। এদিকে এতদিন মুসলমানদের ভোটব্যাংকের কারণে বিশেষ সুবিধা পাওয়া তৃণমূল কংগ্রেস আসন্ন নির্বাচনে তুমুল চাপের মুখে পড়তে পারে। এমনকি নির্বাচনে বিজেপিই চলে আসতে পারে পশ্চিমবঙ্গে।
তবে এ বিষয়ে আব্বাস সিদ্দিকীর মত অবশ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘তৃণমূল উন্নয়নের স্বপ্ন দেখালেও মেলেনি কিছুই। সেই জন্যই পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য নতুন দল। রাজ্যে বিজেপিকে এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।
অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সৌগত রায়ের মতে, আব্বাস সিদ্দিকী নতুন প্লেয়ার হিসেবে মাঠে নামলেও রাজ্যের সংখ্যালঘুদের ভোট তৃণমূলেই পাবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘রাজ্যে সংখ্যালঘুরা তৃণমূলের সঙ্গেই ছিলেন, তৃণমূলের সঙ্গেই থাকবেন।’
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের একটি সূত্রের দাবি, আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে তাদেরও কথা হয়েছে। ধর্মের সঙ্গে যদি সম্পর্ক না থাকে, তাহলে রাজ্যের কয়েকটি আসনে বাম-কংগ্রেস জোটের কাছাকাছি আসতে পারে আব্বাসের দল। তবে সবটাই নির্ভর করছে আব্বাসের দলের সমীকরণ কী হবে, তার উপর। কারণ, ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে বিশেষ করে বামদের পক্ষে সেই দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে জোট তৈরি করা অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে এখন বাম ও কংগ্রেস একজোট হয়েছে। তারা আব্বাস সিদ্দিকীর দলকেও কাছে টানতে চাইছে। এ নিয়ে উভয়ে আলোচনাও চলছে। এতে কংগ্রেস ও বামজোটের আসন কয়েকটি বাড়তে পারে। কিন্তু আখেরে লাভ হবে বিজেপির।
আর আব্বাস সিদ্দিকীর দলও বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোটকেই তাদের স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে করছে। আব্বাস সিদ্দিকীর ভাষায়, রাজ্যের দুই অপশক্তি তৃণমূল ও বিজেপি। তিনি বলেন, ‘এই দুই অপশক্তির বিরুদ্ধে জোট করে লড়তে সম্মত হয়েছি মিম প্রধানের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে আমার নেতৃত্বেই মিম লড়বে। এছাড়া আরও ১০টি দলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাঁরা সবাই আমার নেতৃত্বে লড়তে প্রস্তুত। বিজেপি-তৃণমূলকে হারাতে সবাইকে একই ছাদের তলায় আসতে হবে।’
এদিকে সিপিএমের মোহাম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেসের আবদুল মান্নান, এই দুই নেতা আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোট হারাতে চায় না শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। এ রাজ্যে মুসলিম ভোটের বড় অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে ভোট দেয় বলে মনে করা হয়।
সমীকরণ যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আব্বাস সিদ্দিকী যে নতুন অঙ্ক তৈরি করতে চলেছেন, তা মোটামুটি স্পষ্ট। আব্বাস জানিয়েছেন, তিনি ৪০ থেকে ৫০টি আসনে প্রার্থী দিতে চান। ধরে নেওয়া যায়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসানগুলোই আব্বাস সিদ্দিকীর টার্গেট। যদি তাই হয়, তা হলে সেসব আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে। বিজেপি যার সুযোগ পেতে পারে।
দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকেই রাজ্যের মুসলমানরা ভোট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু বিনিময়ে কোনো দলের কাছ থেকেই এখনও মুসলমানরা তেমন একটা কিছু পাননি। মুসলিম সমাজের শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা প্রশ্ন তুলছে যে, এভাবে শুধুই তো ওইসব দলগুলোর ওপরে ভরসা করে থাকা যায় না। যে রাজ্যেই মুসলিমরা নিজেদের আইডেন্টিটি পলিটিকস করেছে, সেখানে তাদের উন্নয়ন হয়েছে। আসামে করেছেন বদরুদ্দীন আজমল। সে রাজ্যের মুসলমানরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কেরালায় মুসলিম লীগ আছে, সেখানকার মুসলিমরা উন্নতি করেছে। হায়দ্রাবাদ-তেলেঙ্গানায় ওয়াইসির এআইএমআইএম আছে, তার ফলে উন্নয়ন হয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই মুসলমানরা সেক্যুলার দলের সঙ্গে থেকেছে বলেই সব থেকে খারাপ অবস্থা এই রাজ্যে।
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির উত্থানও দৃশ্যমান। গত ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর থেকে সেই ছবি কিছুটা স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার আসন ৪২টি। এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১৮টি। এছাড়া ১৮টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত লোকসভা আসনের ৪টি তৃণমূলের থেকে বিজেপির হাতে গিয়েছে। এগুলো হল বালুরঘাট, কোচবিহার, বনগাঁ ও রানাঘাট। যে যাই বলুক, পশ্চিমবঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকীর দলের প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণার পর থেকেই মুসলিম ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যাতে আখেরে বিজেপিরই লাভ।
এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে চলছে জোর লড়াই। মমতা বলছেন, তৃতীয়বারের মত তারাই ক্ষমতায় আসবেন। সারা পশ্চিমবঙ্গ চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। আর বিজেপিরও এবার জোর এজেন্ডা পশ্চিমবঙ্গ ঘিরে। তারা যেভাবেই হোক তৃণমূলকে হটাতে চায়। তারা ইতোমধ্যেই মমতার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীসহ দলের অনেক বিধায়ক ও নেতাকে ভাগিয়ে নিয়েছেন। খুব ঘনঘন পশ্চিমবঙ্গ সফর করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। মুসলিমদের ভোট কাড়তে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুর নগরে আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে অমিত শাহ বলেন, নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)কার্যকর হলে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নাম বাদ যাবে এ কথা ঠিক নয়। ওরা (তৃণমূল, বামদল এবং কংগ্রেস) মিথ্যা প্রচার করছে।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, আসন বণ্টন নিয়ে আব্বাস সিদ্দিকী ও বাম-কংগ্রেস জোট ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে নি। আব্বাস সিদ্দিকীর দাবি ৪৪টি আসন, তবে আলোচনা সাপেক্ষে কিছু ছাড় দেওয়া হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন আইএসএফ প্রধান নওশাদ সিদ্দিকী। আব্বাস সিদ্দিকী বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন জোট তৈরিতে অযথা দেরি তার পছন্দ নয়। যদি কোনও কারণে সেই জোট না হয়, তবে তিনি একাই ভোটে লড়বেন। ইতিপূর্বে কয়েকটি বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে কোনো ফলাফল আসতে পারে।

আসামে প্রচারণায় বাংলাদেশী প্রসঙ্গ
বাংলাদেশ সীমান্তের লাগায়ো পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম। ফলে উভয় রাজ্যেই নির্বাচনী প্রচারণায় আছে বাংলাদেশ। অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এক নির্বাচনী সমাবেশে বলেছেন, রাজ্যে বিজিপি ক্ষমতায় এলে, বাংলাদেশ থেকে একটি পাখিও সেখানে ঢুকতে পারবে না। আর আসামে বিজেপির প্রধান নেতা হেমান্ত বিশ্বশর্মা এবারের নির্বাচনকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে আসামের সভ্যতা রক্ষার সংগ্রাম’ বলে উল্লেখ করেছেন। আর এই দুই রাজ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ভোট থাকায় এ দেশের অনেক মানুষের মনোযোগও এই নির্বাচনের দিকে।
বিজেপি ও আসাম গণপরিষদ স্থানীয় বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে ভোটের ময়দানে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। তবে এ রাজ্যে জোট গড়ে সুবিধায় আছে কংগ্রেস, আর প্রচারে এগিয়ে বিজেপি। আসামে বিধানসভায় আসন ১২৬। সর্বশেষ ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৬০টি আসন পায়। যা আগের নির্বাচনের চেয়ে ৫৫টি বেশি। ১২৬ আসনের মধ্যে ৮৬টি পেয়ে সরকার গঠন করে বিজেপি ও আসাম গণপরিষদ জোট। বাকি ৪০টির মধ্যে ২৬টি পায় কংগ্রেস এবং ১৪টি আঞ্চলিক দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)। আসামের রাজনীতির তৃতীয় শক্তি এই দল। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল। বিজেপি সুযোগ পেলেই তাঁকে বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে। গরম করছে ভোটের মাঠ। মাওলানা আজমলের দলের ভোট এ রাজ্যের নির্বাচনে একটি বড় ফ্যাক্টর।

কংগ্রেস ও বিজেপির আলাদা জোট
আসামে বহুবছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত একনাগাড়ে তারা এখানে ক্ষমতায় ছিল। এবার কংগ্রেস মাওলানা আজমলের দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) এবং ছোট ছোট বাম দলগুলোর সঙ্গে জোট করার ঘোষণা দিয়েছে। আর বিজেপি বলছে, তারা আগের মতোই ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলনের শক্তি আসাম গণপরিষদের সঙ্গে জোট করবে। এই হিসাব শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকলে কংগ্রেস কিছুটা লাভবান হতে পারে। মুসলিম ভোট আর ভাগ হবে না। আবার এতে বিজেপিরও সুবিধা। কংগ্রেস যখনই মুসলমান প্রধান এআইইউডিএফের সঙ্গে জোট করবে, তখনই বিজেপি জোর প্রচারণায় পুরো ভোটারদের ধর্মের ভিত্তিতে দুভাগ করে ফেলবে। এতে কংগ্রেসের মুসলিম ভোট বাড়লেও হিন্দু ভোট কমবে।
রাজ্যে কংগ্রেসের বড় ভোটব্যাংক মুসলমানরাই। এ রাজ্যের ৩৫ ভাগ মুসলমান ভোট রয়েছে। কংগ্রেস যেসব এলাকায় শক্তিশালী সেগুলো মুসলমানপ্রধান। তবে এই ভোটব্যাংক দুইভাগে বিভক্ত। ৩৫ ভাগ মুসলমানের মধ্যে আছে বাংলাভাষী ও অসমিয়াভাষী ধারা। অন্যদিকে ৬২ ভাগ হিন্দু ভোটারের মধ্যে আছে বোড়ো উপজাতি ও অসমিয়া ধারা। এছাড়া রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা আচরণে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার মাঝেও কিছু ব্যতিক্রম আছে। চা-শ্রমিকেরাও এই রাজ্যে এক ছোটখাটো ভোটব্যাংক। ১২৬ আসনের ৪৫টিতে তাঁরা আছেন বিভিন্ন সংখ্যায়। একসময় অতি দরিদ্র এই শ্রমিকেরা কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। এখন অবস্থা সেরকম নেই। ভোট কাড়তে বিজেপি সাত লাখ শ্রমিককে ৩ হাজার রুপি করে নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
আসাম গণপরিষদ ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলনের বড় শক্তি। আসাম গণপরিষদ মনে করে রাজ্যের মুসলমানরা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছে। অতএব ‘বিদেশি খেদাও’ এই স্লোগান তাদের। নির্বাচন এলেই যা আরো জোরালো হয়।
অসমিয়া তরুণেরা বিজেপির বিরুদ্ধে
বিজেপি এবার কিছু কৌশলগত অসুবিধায় আছে। কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোট তাদের জন্য ভোটের গণিতে এক বড় চ্যালেঞ্জ। আরও বড় সংকট অনেক অসমিয়া তরুণের ভোট তারা হারাতে পারে। আসামে ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে’র বাস্তবায়ন চায় না এই অসমিয়ারা। এ রকম অন্তত দুটি দল নির্বাচনে আলাদা জোট করেছে। এ হিসাবে গতবারের চেয়ে বিজেপির ভোট কমে যেতে পারে।
তবে বসে নেই বিজেপি। তারা নতুন কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে। বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে ‘মিঞা’ তকমা দিয়ে আসামের খলচরিত্র হিসেবে তুলে ধরছে তারা। আর এভাবে কংগ্রেস ও মাওলানা আজমলের দল এআইডিইউএফ জোটকে সমগ্র ভোটারদের কাছে ‘আসামবিরোধী’ ও ‘বাংলাদেশপন্থী’ হিসেবে দেখানোর কৌশল নিয়েছে বিজেপি। এ নিয়ে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চলছে তাদের জোর প্রচারণা। নির্বাচনের বিজেপির প্রধান সেনাপতি সীমান্ত বিশ্বশর্মা ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছেন: ‘আমরা মিঞাদের ভোট চাই না।’ তাঁর মতে ‘মিঞা’ মুসলমানরা ‘বাংলাদেশ থেকে আসামে গিয়েছে।’
অসমিয়াদের স্বতন্ত্র জোট
কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে আসামে এবার তৃতীয় জোটটি গড়েছে দুটি আঞ্চলিক দল। একটির নেতৃত্বে কৃষকনেতা অখিল গগৈ। দলের নাম ‘রাইজর দল’। অসমিয়া ভাষায় রাইজর মানে জনতা। অখিল গগৈ এক বছর ধরে কারাগারে। বারবার তাঁর জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। ডিব্রুগড়, তিনসুকিয়া, দেমাজি, মাজুলি প্রভৃতি অসমিয়াপ্রধান জেলায় এই দলের প্রভাব আছে। এককালে এসব জেলায় উলফার প্রভাব ছিল। রাইজর দলের সঙ্গে আছে আসাম জাতীয় পরিষদ। এর নেতৃত্বে লুরিন জয়তী গগৈ। দুটি দলই আসামে নাগরিকত্ব নেই এমন অ-মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরোধী।
নাগরিকত্ব আইন ও ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ইস্যু
এবারে আসামর নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্ম ও জাতিগত বিভেদ-সংঘাতই প্রধান ইস্যু। দীর্ঘদিন এই রাজ্যে বিতর্কের প্রধান বিষয় তথাকথিত নাগরিকত্ব আইন ও ‘অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান’ ইস্যু। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই ইস্যুতে আসাম উত্তাল। একসময় বলা হতো প্রায় এক কোটি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ আছে আসামে। তার খোঁজ নিতে ‘এনআরসি’ (নাগরিকদের শনাক্ত করা) হয়। ওই দাবির সত্যতা মিলেছে সামান্যই। হিন্দু-মুসলমান মিলে মাত্র ১৯ লাখ নাগরিকের কাছে নাগরিকত্বের কাগজপত্রের অভাব দেখা গেছে। সাড়ে তিন কোটি মানুষের রাজ্যে যা মাত্র ৫ শতাংশের মতো। আর এর মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি। বিজেপি বাদপড়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিতে চাইলেও অসমিয়ারা এর ঘোর বিরোধী। তারা নতুন করে আসামে কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিপক্ষে। কিন্তু যাদেরকে অবৈধ বলা হচ্ছে, সেই অবৈধদের দাবি বিজেপি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলেও যুগের পর যুগ ধরে তারা আসামেই বাস করছে।
এদিকে বিজেপির মূল সংগঠন আরএসএস বরাবরের মতো রাজ্যে মুসলমান ভীতি ও ঘৃণা ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় তারা উসকে দিচ্ছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। নির্বাচনী পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। উল্লেখ্য, অতীতে বাংলা ও আসাম ছিল এক দেশ। বৃহৎ বঙ্গদেশের অংশ ছিল আসাম। ব্রহ্মপুত্রের একই উপত্যকায় তাদের চিরস্থায়ী অবস্থান। অথচ সেই আসাম ১৯ লাখ স্থানীয়কে ‘বাংলাদেশি তকমা দিয়ে ‘রাষ্ট্রবিহীন’ করে রেখেছে।

লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক প্রথম আলো

ফেইসবুকে আমরা...